চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও দক্ষিণ জুড়ে বয়ে চলা ধনাগোদা নদী—এ নদী ছিল বৃহত্তর মতলবের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত জীবনধারা। কৃষি, মাছধরা, বাণিজ্য, নৌপথ—সবকিছুর প্রাণ ছিল এই নদী। মানুষ এই নদীর ওপর ভরসা করে গড়ে তুলেছিল বাজার, ঘাট, জীবিকার নানা ক্ষেত্র। এক সময় নদীর বুক জুড়ে দেখা যেত লঞ্চ, ট্রলার, যাত্রীবাহী নৌকা, ব্যবসায়িক জাহাজ—প্রতিটি ঢেউ ছিল অর্থনীতির প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস। অথচ আজ নদীটি যেন শুধুই স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে মানুষের কাছে। জলরাশি পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কচুরিপানার দেয়াল নদীটিকে বেঁধে ফেলেছে নীরব মৃত্যুর দিকে। নদীর বুক ভরে উঠেছে এমন মোটা স্তরের সবুজে, যা নদীর অস্তিত্বকেই গিলে খাচ্ছে। আজ সেই নদী আর নদী নেই — নদীর জায়গায় দাঁড়িয়ে জন্ম নিয়েছে এক অবাঞ্ছিত খেলাধুলার মাঠ!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলিতে দেখা যায়—শ্রী রায়েরচর ব্রীজের নিচে কচুরিপানার উপর ফুটবল খেলছে স্থানীয় যুবকেরা। প্রথম দেখায় হাসির খোরাক। দ্বিতীয়বার দেখলে মনে হয়—কী ভয়ংকর শূন্যতা, কী অসহায় মৃত্যু! নদীর প্রতি এমন অবহেলা আর ব্যর্থতার প্রতীক আর কিই-বা হতে পারে? নদীর বুক চিরে যে স্রোত চলার কথা—সেই বুকে আজ বল গড়াচ্ছে। নদীতে যখন নৌকা চলে না, তখন সেখানে ফুটবল বা ভলিবল চলার সুযোগ তৈরি হয়—এটাই ধনাগোদার বর্তমান বাস্তবতা। এই বিপর্যয়ের গভীরতা বুঝতে হলে কেবল দৃশ্য দেখা যথেষ্ট নয়; অনুভব করতে হবে নদীর আর্তচিৎকারও। কালীপুর থেকে কালিরবাজার পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার জুড়ে কচুরিপানার দখল। আমিরাবাদ লঞ্চঘাট থেকে কালিপুর পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার নদীপথ একই সংকটে হারিয়ে ফেলেছে তার স্রোত। আজ শ্রীরায়েরচর এলাকাসহ নদীর বহু স্থানে স্থানীয়রা হেঁটে চলে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। নদী কি তবে মাটিই হয়ে যাচ্ছে? নদীর শ্বাস কেড়ে নিয়ে মানুষ সেখানে শর্টকাট রাস্তা তৈরি করে চলেছে—এ যেন নদী নয়, মৃত জলাভূমি! একসময় ধনাগোদা নদীর বুকে যে জীবন-চাঞ্চল্য দেখা যেত, আজ তার জায়গায় স্থিরতা—অচলাবস্থা—মৃত্যুর ছায়া। নৌযান চলাচল যখন থেমে যায়, তখন থেমে যায় মানুষের জীবন—এ সত্য কথাকে আজ প্রমাণ করে নদীর বুকে আটকে থাকা অসংখ্য বালুবাহী জাহাজ। ১০-১২ দিন নয়, আরও দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকা শ্রমিকেরা নৌকাতেই কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন দিনরাত। চাকরি হারানোর ভয়—অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—পরিবারের চিন্তা—সব মিলিয়ে নদীর স্রোতের সঙ্গে তাদের ভাগ্যও থমকে গেছে। এক শ্রমিকের মুখে শোনা যায় বিষাদের স্বীকারোক্তি—“নদী না চললে আমাদের জীবনও থামবে।” এই বাক্যে যেন ধনাগোদা নদীর মৃত্যুঘণ্টা বাজে!
নদীর মৃত্যু কখনো একদিনে হয় না—ধীরে ধীরে, অবহেলা আর দখলদারির নিঃশব্দ আঘাতে নদী মরে যায়। ধনাগোদা নদীর নাব্যতা হারানোর পেছনে যে কারণগুলো দীর্ঘদিন ধরে বিস্তার করেছে, তার মধ্যে প্রথমেই আসে অবৈধ ঝাঁক স্থাপনের দুঃসাহসিক প্রবণতা। নদীর দুই পারে অসংখ্য ঝাঁক দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বছরের পর বছর। পানি প্রবাহ বাধার কারণে নদীর বুক জমে গেছে কচুরিপানায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—যখন নদীর স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন কচুরিপানা স্থায়ীভাবে শেকড় গেঁড়ে বসে পড়ে। এই শেকড়ই আজ নদীর জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রী রায়েরচর ব্রীজের অপরিকল্পিত নির্মাণ—যা পানি প্রবাহকে সংকুচিত করেছে অস্বাভাবিকভাবে। নদীর বুকে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক সঞ্চালন না থাকায় কচুরিপানা সহজে সরে যেতে পারে না। নদীর রক্তস্রোত থেমে গেছে—জলবায়ুর স্বাভাবিক ওঠানামা ব্যাহত হয়েছে। প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে তার মূল্য দিতে হয় পরিবেশকে, দিতে হয় মানুষকে—এ যেন তারই করুণ বাস্তব রূপ।
এই নদী শুধু পানির শরীর নয়—এটাই ছিল মতলববাসীর অর্থনৈতিক ইঞ্জিন। মাছের বাজার থেকে শুরু করে নৌমাল পরিবহন—সবকিছু আজ থেমে গেছে। কৃষিপণ্য বহনের বিকল্প পথ না থাকায় ব্যয় বেড়ে গেছে, আয়ের পথ কমে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবার জীবনে অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশা। বছরের পর বছর ধরে স্থানীয়দের দাবি—নদী খনন করতে হবে। দখল উচ্ছেদ করতে হবে। ঝাঁক তুলে দিতে হবে। নদীতে স্রোত ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু কথার কথা নয়—মানুষের আর্তনাদ। নদীর ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা জনপদ চাই নদীর প্রাণফেরা। এখনো স্থানীয় প্রশাসন সমস্যা শনাক্ত করলেও স্থায়ী সমাধান এখনো দেখা যায়নি। পদক্ষেপের কথা আসে—কাগজে-কলমে পরিকল্পনা হয়—কিন্তু মাঠে কার্যকর উদ্যোগের দেখা মেলে না। বিলম্বই যেন এখন প্রশাসনিক অভ্যাস। অথচ নদীকে বাঁচাতে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে নদীকে অস্তিত্বের লড়াই থেকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। ধনাগোদা নদী আজ আমাদের সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলে ধরেছে—নদী কি আমাদের উন্নয়নের শত্রু হয়ে গেছে? নাকি আমাদের উন্নয়নের ভুল ধারণাই নদীর শত্রু? যে নদী শত বছর ধরে আমাদের বাঁচিয়েছে—আমরা কি সেই নদীকেই হত্যা করতে উদ্যত? যখন নদী হারিয়ে যাবে—আমরা কি তখন আফসোস করে বলব, “কার আগে?” প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় কঠিন—এ প্রতিশোধে মানুষ টিকে থাকতে পারে না। ধনাগোদা নদীকে বাঁচানোর দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়—এটি প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। কিন্তু সরকারই নিতে হবে নেতৃত্ব। নদী পুনরুদ্ধারের জন্য চাই:
— নিয়মিত ড্রেজিং
— অবৈধ ঝাঁক অপসারণ
— নদীর স্বাভাবিক কাঠামো রক্ষায় পরিকল্পনা
— প্রাকৃতিক প্রবাহ ও জোয়ার-ভাটার গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা
— নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ
কারণ নদী না থাকলে মতলব থাকবে না, থাকবে না তার অর্থনীতি, তার ঐতিহ্য, তার ভবিষ্যৎ। আজকের ধনাগোদা নদী আমাদের মুখের ওপর চিরকুট এঁকে দিয়েছে—নদী যখন ফুটবল মাঠে পরিণত হয়, তখন মানুষকে বুঝে নিতে হয়—সমাজের বিবেক ব্যর্থ হয়েছে।
ধনাগোদা বাঁচলে মতলব বাঁচবে। নদী বাঁচলে জীবন বাঁচবে। এই সত্য অস্বীকার করলে সর্বনাশ হবেই। এখনও সময় আছে—কিন্তু খুব বেশি নেই। আজ নদীর স্রোত থেমে গেছে, কিন্তু মানুষের বিবেক যেন না থামে। ধনাগোদা নদী যেন আবারো তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে— জীবন, কর্মসংস্থান আর আশার স্রোত নিয়ে। “নদী বাঁচাও, মতলব বাঁচাও — আজ, এখনই।”
লেখক :
আজম পাটোয়ারী
প্রকাশক
আরডিএম মিডিয়া এন্ড প্রকাশনী।