আজকের ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, মেসেঞ্জার বা যেকোনো চ্যাট প্ল্যাটফর্ম—সবকিছুই এখন মানুষের পরিচয়, বন্ধু-পরিচিতি, ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজেদের জীবনের আনন্দ-বেদনা, অভিজ্ঞতা এবং ভাবনা অনলাইনে প্রকাশ করি। কিন্তু এই সুবিধার সঙ্গে এসেছে অনৈতিক ব্যবহারেরও সুযোগ, যা কখনো কখনো আমাদের সামাজিক ও মানসিক পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
সম্প্রতি অনলাইনে একটি চরমরকমের “দ্বৈত চরিত্র” বা সুবিধাবাদী আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি সাধারণত দেখা যায় অনলাইন চ্যাট এবং ব্যক্তিগত কথোপকথনের ক্ষেত্রে। প্রায়ই কিছু মহিলা ইনবক্সে ছেলেদের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে এটি হয় বন্ধুত্ব বা সাধারণ আলাপচারিতার নামে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই চ্যাটের স্ক্রিনশটকে ব্যবহার করে নিজেকে “নিরপরাধ” বা “দেবী” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এরপরই পোস্টের নিচে হাজির হয় একঝাঁক সমর্থক, যারা মন্তব্য করে—“আপা আপনি খুব সরল মেয়ে! ওর মতো ছেলেরা সমাজের কলঙ্ক!”
এই পরিস্থিতি আমাদের সামনে তুলে ধরে অনলাইনে কৃত্রিম ন্যায়বিচারের চিত্র। যেখানে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে একটি পাবলিক নাটক বা শো-অফে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো—যখন কোনো ছেলে ইনবক্সে সঠিক বা ভুলভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে, তখন কেন তাকে ব্লক বা রিপোর্ট করা হয় না? কেন চ্যাটের অংশগুলো মুছে ফেলে শুধুমাত্র ছেলেটির কথাগুলো প্রকাশ করা হয়, তাকে ভিলেন বা অপরাধী হিসেবে দেখানোর জন্য?
অনলাইনে এমন দ্বৈত চরিত্রের ফলে সামাজিক সম্পর্কের মানদণ্ড খুবই বিকৃত হয়ে যায়। একদিকে আমরা দেখছি, ব্যক্তি সুবিধা নিচ্ছে, অন্যদিকে সেই একই ব্যক্তিকে অপরাধী বা ভিলেন বানিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। এটি শুধু ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক শোরগোল এবং কৃত্রিম ন্যায়বিচারের উদাহরণ।
এখন ভাবুন, অনলাইনে ব্যবসা করা অনেক মেয়ের পেইজ বা আইডিতে পুরুষ ফলোয়ারের সংখ্যা মেয়ের চেয়ে দ্বিগুণ। এই পুরুষদের মাধ্যমে তারা প্রমোশন, উপহার, ‘সাপোর্ট’ বা অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু একই সময়ে সুযোগ পেলেই এই পুরুষদের খারাপ বা নোংরা চরিত্রের ট্যাগ দিয়ে লাঞ্চিত করছেন। এটি কি শুধুই ব্যক্তিগত রকমফের নয়? না, এটি দুটি স্তরের দ্বৈত চরিত্র, যেখানে একজন ব্যক্তি এক সময় সুবিধা নিচ্ছেন, অন্য সময় তাকে সামাজিকভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
সামাজিক মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এমন আচরণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। অনলাইনে ‘দেবী’ বা ‘নিরপরাধ’ হিসেবে নিজের ইমেজ গড়ে তোলার জন্য ব্যক্তি প্রায়শই নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এটি শুধু অনৈতিক তা নয়, বরং এক ধরনের ক্ষমতার খেলা, যেখানে অন্য মানুষকে ‘নির্ধারিত ভিলেন’ হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
এই ধরনের আচরণ আমাদের সামনে তুলে ধরে এক বড় বাস্তবতা—অনলাইনে আমরা প্রায়শই নিজের সুবিধার জন্য নৈতিকতার মানদণ্ড পরিবর্তন করি। যদি কেউ আমাদের সুবিধাজনক হয়, সে ভালো। যদি কেউ সুবিধা না দেয়, সে খারাপ। এই ধরণের দ্বৈত মানসিকতা সামাজিক সম্পর্কের ভেতরে বিরূপ প্রভাব ফেলে। বন্ধুত্ব, প্রেম বা ব্যবসায়িক সম্পর্কের প্রকৃত মানসিকতা অনলাইনে বিকৃত হয়।
এখনই আমরা দেখতে পাই, অনলাইনে কৃত্রিম ন্যায়বিচার এবং সামাজিক শোরগোলের প্রভাব কতটা বিস্তৃত। পোস্টের নিচে হাজির “আবাল সেনা”রা, যারা মন্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে আপা-কে প্রটেক্ট করার নামে সোশ্যাল প্রোফাইলকে আরও শক্তিশালী করছেন। এটি একটি ধরনের সামাজিক শোরগোল, যেখানে আসল বিষয়ের পরিবর্তে প্রেজেন্টেশন এবং ইমপ্রেশনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাস্তবে তারা কি সত্যিই সাহায্য করছে, নাকি কেবল নিজের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছে?
এই পরিস্থিতি আমাদের সামনে তুলে ধরে, সামাজিক যোগাযোগের একটি গভীর সংকট। অনলাইনে দ্বৈত চরিত্র, সুবিধাবাদী ব্যবহার এবং কৃত্রিম ন্যায়বিচার—এগুলো আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে যে, আমরা কীভাবে নিজেদের সামাজিক ও নৈতিক মান বজায় রাখতে পারি।
1. ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে: অনলাইনে অনেক মেয়ের পেইজে পুরুষ ফলোয়ার দ্বিগুণ। এই পুরুষদের মাধ্যমে তারা প্রমোশন, গিফট, ‘সাপোর্ট’ পান। কিন্তু যদি কখনো পুরুষদের কোনো কারণে সুবিধা না পান, তারা সেই পুরুষদের খারাপ বা নোংরা চরিত্রের ট্যাগ দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করেন। এটি পরিষ্কারভাবে দেখায় যে, সুবিধাবাদী মনোভাব সব সময় নৈতিকতার চেয়ে প্রাধান্য পায়।
2. ব্যক্তিগত চ্যাটে: অনেক সময় দেখা যায়, কোনো ছেলেকে ইনবক্সে সরলভাবে আলাপের সুযোগ দেওয়া হয়। পরে সেই আলাপের স্ক্রিনশট মুছে শুধু ছেলেটির কথাগুলো প্রকাশ করা হয়, যাতে সে ভিলেন বা অপরাধী হিসেবে প্রেজেন্ট হয়। এটি শুধুই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নয়, বরং সামাজিক শোরগোলের অংশ।
3. মনের দ্বৈত মানসিকতা: অনলাইনে আমরা দেখি, নিজের সুবিধার জন্য নৈতিকতা পরিবর্তন করা হচ্ছে। যখন সুবিধা প্রয়োজন, তখন সম্পর্ক ভালো। যখন সুবিধা নেই, তখন সেই সম্পর্ককে দোষারোপের মাধ্যমে সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে।
এই সমস্যার আরও গভীর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটি কেবল অনৈতিকতা নয়, বরং এক ধরনের ক্ষমতার খেলা। অনলাইনে মানুষ নিজেদের ইমেজ, প্রেজেন্টেশন এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য অন্যকে দোষারোপ করে। এটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে সামাজিক নাটকে রূপান্তরিত করে।
1. সচেতন ব্যবহার: অনলাইনে যেকোনো চ্যাট বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতাকে সংরক্ষণ করুন, কিন্তু সম্মতি ছাড়া প্রকাশ করবেন না।
2. দ্বৈত চরিত্রের ফাঁদ থেকে দূরে থাকা: যদি কেউ সুবিধা নিতে আসে, সে গ্রহণ করুন, কিন্তু চ্যাটের অংশ প্রকাশ করার আগে দুইবার চিন্তা করুন।
3. নিজের নৈতিকতার সঙ্গে আপস করবেন না: সামাজিক প্রভাবের চাপে নিজের নৈতিকতা বিকৃত করা থেকে বিরত থাকুন।
4. অনলাইন সমর্থকদের জন্য সচেতনতা: যারা মন্তব্য বা সমর্থন দিয়ে নিজের ইমপ্রেশন বাড়াচ্ছে, তাদের উচিত ভাবা—কৃত্রিম ন্যায়বিচার তৈরি করা বা অন্যকে হেয় করা কি সত্যিই সহায়ক?
এছাড়া, এই ধরণের অনৈতিক বা সুবিধাবাদী আচরণের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা থাকতে পারে। যেসব ব্যক্তি অনলাইনে নিজের নৈতিকতা বিকৃত করে, তারা প্রায়শই বাস্তব জীবনে মানসিক চাপ, আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকে। তাই সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো অনলাইন ব্যবহারে নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
অনলাইন দ্বৈত চরিত্র, সুবিধাবাদী ব্যবহার এবং সামাজিক শোরগোল আমাদের শেখায়—প্রত্যেকটি চ্যাট, প্রতিটি পোস্ট এবং প্রতিটি মন্তব্যই আমাদের নৈতিকতার আয়না। এটি কেবল ব্যক্তিগত জীবন নয়, এটি সামাজিক স্বাস্থ্য ও অনলাইন নৈতিকতার প্রতিফলন। সচেতন ব্যবহার, নিজের আচরণের প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব এবং সমাজকে নৈতিকভাবে পরিচালিত করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা অনলাইনে এবং বাস্তব জীবনে দায়িত্বশীল, নৈতিক ও প্রাসঙ্গিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
একটি সমাজ যেখানে আমরা নিজেদের সুবিধা, ক্ষমতা বা ইমেজের জন্য অন্যকে ব্যবহার করি না, সেই সমাজ কেবল বাস্তব জগতেই নয়, অনলাইনেও আমাদের সম্পর্ককে সুস্থ ও নৈতিকভাবে গড়ে তুলতে পারে। আর তাই, দ্বৈত চরিত্রের এই চিত্র আমাদের জন্য এক প্রজন্মের শিক্ষা—সচেতন ব্যবহার, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়িত্ব একসাথে চললে অনলাইন সমাজও নিরাপদ, ন্যায়সঙ্গত এবং সমৃদ্ধ হতে পারে।
আরডিএম মিডিয়া এন্ড প্রকাশনী।