November 6, 2025, 9:53 pm
শিরোনামঃ
দল-মত নির্বিশেষে চাঁদপুর-২ আসনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তানভীর হুদা বিনয়বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব পরিদর্শন  কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-এ প্রথমবারের মতো বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রথম কেবল স্টেইড ব্রিজ হবে মতলব-গজারিয়া সেতু : সেতু সচিব আবদুর রউফ মতলব উত্তরে জাটকা রক্ষা অভিযানে ১২০ কেজি জাটকা উদ্ধার ; এতিমখানায় ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ মতলব উত্তরে গাঁজা চাষের সন্ধান ; ৪টি গাছ উদ্ধার ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ভাঙলে বহিষ্কার: ছেংগারচর সরকারি কলেজের কঠোর নির্দেশনা বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন মাহতাবকে জরিয়ে ভুয়া কল রেকর্ড প্রচারণা চাঁদপুর-২ আসনের বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার পর বাবা-মা’সহ প্রয়াত বিএনপির নেতাদের কবর জিয়ারতে ড. জালাল উদ্দীন অনলাইন নারীর দ্বৈত চরিত্র : সুবিধাবাদী ব্যবহার ও সামাজিক দ্বন্দ্ব

সুলতান-উল-হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রাহমুতুল্লাহ)

Reporter Name

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের উজ্জল আলো বিতরণকারী নক্ষত্র সুলতান-উল-হিন্দ, গরীবে নেওয়াজ খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (র) হলেন চিশতীয় ধারার ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক।

সুলতান-উল-হিন্দ খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ( উর্দু / ফার্সি : خواجہ معین الدین چشتی; আরবি: خواجة معين الدين الششتى ) ছিলেন একজন পারসিক সুন্নি মুসলিম প্রচারক, সৈয়দ, তপস্বী, ধর্মীয় পণ্ডিত, দার্শনিক, সুফি সাধক ও সিস্তানের রহস্যবাদী, যিনি তার শেষ জীবনে ১৩ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি সুন্নি রহস্যবাদের বিখ্যাত চিশতিয়া তরিকা প্রচার করেন। ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৩৬ সালে পরলোকগমন করেন। তিনি গরিবে নেওয়াজ ( غریب نواز ) নামেও পরিচিত। মইনুদ্দিন চিশতীই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম চিশতী ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন এবং তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক সিলসিলাকে এমনভাবে পরিচিত করেন যে, তা গোটা ভারতে ছড়িয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী; যেমন: কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রমুখ ভারতের ইতিহাসে এই সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

প্রারম্ভিক জীবন ও নেপথ্য :

ধারণা করা হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৫৩৭ হিজরী/১১৪২ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পারস্যের সিস্তান রাজ্যের সানজারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যে বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তার পিতার নাম গিয়াসউদ্দিন এবং মাতার নাম বিবি উম্মালওয়ারা (ওরফে বিবি মাহে-নূর), ছিলেন সৈয়দ বা মুহাম্মদ (দ.)-এর বংশধর, তার নাতি হাসান এবং হোসাইনের মাধ্যমে। তিনি তার পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র (উইন্ডমিল) ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুসারে, একদিন তিনি তার ফলবাগানে জল দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী (কুন্দুজী নামটি জন্মস্থান কুন্দুজ থেকে এসেছে)। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজীকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এরপর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এরপর তিনি বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি বুখারা এবং সমরকন্দের সেমিনারিতে ভর্তি হন এবং (সম্ভবত) মুহাম্মদ আল-বুখারি (মৃত্যু ৮৭০) এবং আবু মনসুর আল-মাতুরিদি (মৃত্যু ৯৪৪) এর মাজার পরিদর্শন করেন, যা ইসলামি বিশ্বের ব্যাপকভাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।

ইরাক ভ্রমণের সময়, নিশাপুর জেলায়, তিনি বিখ্যাত সুন্নি রহস্যবাদী খাজা উসমান-এর সাথে দেখা করেছিলেন, যিনি তাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের সাথে পরবর্তী অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ভ্রমণে, মঈনুদ্দিন সেই সময়কালে তার নিজস্ব স্বাধীন আধ্যাত্মিক ভ্রমণও চালিয়ে যান।[ তার স্বাধীন বিচরণে মঈনুদ্দিন সেই যুগের অনেক উল্লেখযোগ্য সুন্নি রহস্যবাদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যার মধ্যে ছিলেন আবদুল কাদের জিলানী (মৃত্যু ১১৬৬) এবং নাজমুদ্দিন কুবরা (মৃত্যু ১২২১), পাশাপাশি নাজিব আল-দীন আবদ-আল-কাহির সোহরাওয়ার্দী, আবু সাঈদ তাবরিজি, এবং আবদ আল-ওয়াহিদ গজনবীও ছিলেন, যাদের সবাই সুন্নি ঐতিহ্যের সবচেয়ে সম্মানিত সুফি সাধক ছিলেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় আগমণ :

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৌঁছে মঈনুদ্দিন বিখ্যাত সুন্নি রহস্যবাদী এবং আইনজ্ঞ আলী হুজভিরি (মৃত্যু ১০৭২) এর মাজারে ধ্যান করার জন্য প্রথম লাহোরে যান।

সূফি দীক্ষা :

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতীয়া তরীকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরীদ হন/শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন।

ভ্রমণ :

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। তার জীবনীতে বর্ণিত আছে যে, এ সময় আব্দুল কাদির জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

ভারতবর্ষে ইসলাম  ধর্ম প্রচার :

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।[৪][১০] তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল “আনিসুল আরওয়াহ”।

আধ্যাত্মিক ধারা :

খাজা গরিবে নেওয়াজ চিশতীর (র) আধ্যাত্মিক ধারা ঐতিহ্যগতভাবে নিম্নরূপ:

১. মুহাম্মদ (সাঃ)

২. আলী বিন আবি তালিব (মৃত্যু ৬৬১)

৩. হাসান আল-বসরী (মৃত্যু ৭২৮)

৪. আব্দুল ওয়াহিদ বিন যায়েদ (মৃত্যু ৭৮৬)

৫. আল-ফুযাইল বিন ʿইয়াদ (মৃত্যু ৮০৩)

৬. ইব্রাহিম ইবনে আদহাম আল-বলখী (মৃত্যু ৭৮৩)

৭. হুজাইফা আল-মার’শি (মৃত্যু ৮৯০)

৮. আবু হুবায়রা আল-বসরী (মৃত্যু ৯০০)

৯. খাজা মুমশাদ উলু আল দিনাওয়ারী (মৃত্যু ৯১১)

১০. আবু ইসহাক শামী (মৃত্যু ৯৪১)

১১. আবু আহমদ আবদাল চিশতি (মৃত্যু ৯৬৬)

১২. আবু মুহাম্মদ চিশতী (মৃত্যু ১০২০)

১৩. আবু ইউসুফ ইবনে সামান মুহাম্মদ সামআন চিশতী (মৃত্যু ১০৬৭)

১৪. মওদুদ চিশতী (মৃত্যু ১১৩৩)

১৫. শরীফ জান্দানি (মৃত্যু ১২১৫)

১৬. উসমান হারুনী (মৃত্যু ১২২০)

১৭. খাজা সোহরাব হোসেন খান চিশতী (অনন্ত মৈত্রী) খাজা বাবার “সত্তা” আধ্যাত্মিক প্রেম-প্রেমিক শিষ্য।

খেলাফত প্রদান :

তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

ভারতবর্ষে আগমন ও ইসলাম প্রচার :

খাজা গরিবে নেওয়াজ মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী ছিলেন মুবাল্লিগ, মুফাক্কির, উদার, সহানুভূতিসম্পন্ন, বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীর মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব।

হযরত মুঈনুদ্দীন হাসান ৫৩৬ হিজরিতে ইমাম গাযযালীর মৃত্যুর ৩১ বছর পর, পারস্যের সিজিস্তান নামক প্রদেশের সানজা নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান ছিলেন একজন ধনবান ও প্রভাবশালী বণিক। মাতার নাম ছিল মাহে নূর। তার দ্বাদশতম পুরুষের মাধ্যমে পিতামাতা উভয়দিক হতে আলী রা. সাথে সম্পর্কিত। ফলে তিনি পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়েই ছিলেন সাইয়্যিদ। (এমদাদিয়া লাইব্রেরি, তায্কেরাতুল আওলিয়া,খণ্ড-৪,পৃষ্ঠা-২৭১)

খাজা সাহেবের পনেরো বছর বয়সে পিতা মৃত্যুবরণ করেন এবং অল্প কিছু দিন পরে তার মাতাও ইন্তেকাল করেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি ফলের বাগান ও একটি চাক্কি (উইন্ডমিল) লাভ করেন; যার আয়ের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। তার মনে ইসলামের প্রতি গভীর আকর্ষণ জন্ম নেয়। তিনি যাবতীয় সম্পত্তি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সংসারের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন এবং উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বুখারায় পাড়ি জমান।  গরিবদের প্রতি তার অসীম মমতা ছিল, সবসময় তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন তিনি। এ কারণেই তাকে ‘গরিবে নেওয়াজ’ বলে ডাকা হয়।(গরিবে নেওয়াজ, সুলতানে হিন্দ, রোর বাংলা)

খাজা মুঈনুদ্দীন ইলমের সন্ধানে গৃহত্যাগ করেন এবং বোখারা, সমরকন্দ সফর করেন। তিনি প্রথমে কুরআন হিফজ করেন। অতঃপর তাফসির, হাদিস, ফিকাহ ও অন্যান্য শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেন।  খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আধ্যাতিক জ্ঞানার্জনে ও মুর্শিদের অন্বেষণে বোখারা থেকে ইরাকের দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে নিশাপুরে হারুন নামক স্থানে চিশতিয়া তরিকার বিখ্যাত বুজুর্গ উসমান হারুনীর সাথে সাক্ষাৎ হয়।  তিনি চিশতিয়া তরিকায় খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরিদ হন ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।  তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত থাকেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন। (আরবি উইকিপিডিয়া, খাজা মুঈনুদ্দীন সিজযী) উসমান হারুনীর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি হজব্রত পালনের জন্য দামেস্ক ও হেযায হয়ে মক্কা মুয়াজ্জমায় পৌঁছেন, অতঃপর মদিনা মুনাওয়ারা গিয়ে রাসূলের রওজা জিয়ারত করেন।  এরপর তিনি বাগদাদ অভিমুখে যাত্রা করেন এবং পথিমধ্যে অনেক ওলামা-মাশায়েখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; যাদের মধ্যে নাজিমুদ্দিন কোবরা উল্লেখযোগ্য।  এ সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন আলমুস্তানজিদ বিল্লাহ। অনেকের মতে মুঈনুদ্দীন চিশতী শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ৫৭ দিন তার সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেন।  খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী বাগদাদ থেকে আবার সফর শুরু করেন এবং তাবরিয, ইস্পাহান, আস্তারাবাদ, সাবযাওয়ার, মিহনা, বলখ এবং গযনী হয়ে হিন্দুস্তানের লাহোরে আগমন  করেন। লাহোরে শায়খ আলী হুযবিনীর মাজারে কিছুকাল মুরাকাবায় অতিবাহিত করে দিল্লি চলে আসেন।  সে সময় ভারতবর্ষের আজমির ছিল হিন্দু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা এবং সাম্রাজ্য ও রাজপুত শক্তির মূল কেন্দ্রস্থল। ১০ মুহররম ৫৬১ হিজরিতে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরে চল্লিশজন দরবেশসহ দিল্লি থেকে আজমীরে পৌঁছান।  এ সময় আজমীরের শাসনকর্তা ছিলেন পৃথ্বিরাজ বা রায় পথুরা। ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায়, সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মাদ ঘুরি প্রথম পর্যায়ে তার অভিযান উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু রাজা পৃথ্বিরাজ তার দরবারের জনৈক সভাসদ যিনি খাজা সাহেবের মুরিদ ছিলেন কষ্ট ও বিপদের মধ্যে ফেলেন। এরপর প্রতিকার চেয়ে খাজা সাহেব পৃথ্বিরাজকে পত্র লেখেন। পৃথ্বিরাজ অবমাননাকর ভাষায় পত্রের জবাবে বলেন, ‘এই লোকটি এখানে আসার পর এমন বড় বড় কথা বলেন যা কেউ কখনো বলেনি আর শোনেওনি।’

হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী জবাবে বলেন, ‘আমি পৃথ্বিরাজকে জীবিত বন্দি করে মুহাম্মাদ ঘুরির হাতে তুলে দিলাম।’

এরপরই মুহাম্মাদ ঘুরি আজমীর আক্রমণ করেন এবং পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করেন। (গোলাম আলী আজাদ, মাআছিরুল কিরাম,পৃষ্ঠা-৭)

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী কর্তৃক আজমীরকে দাওয়াত,তাবলিগ ও তাজকিয়ার জন্য মনোনীত করা ছিল এক আধ্যাত্মিক বিজয়। তার এই অটুট সংকল্প, উচ্চ মনোবল ও ইমানি সাহসিকতার বদৌলতে সত্যিকার ধর্মবিশ্বাস  হতে বঞ্চিত ভূখণ্ডে তাওহীদের আলো ছড়িয়ে পড়ে। তার তাকওয়া, লিল্লাহিয়াত, খোদাভীরুতা ও ঐকান্তিক ত্যাগ স্বীকারের ফলে কুফর ও শিরকের রাজত্ব ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ওলামায়ে কেরামের আবাসভূমিতে পরিণত হয়।(সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী, তারীখে দাওয়াত ওয়া আজিমত, খণ্ড-৪)

একমাত্র খাজা মুঈনুদ্দীনের প্রচেষ্টা ও প্রভাবে যেখানে শিরকের কালো অন্ধকার বিরাজ করত সেখানে মসজিদ, মিম্বার দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। যে আসমান পৌত্তলিকতা ও শিরকের বিষবাষ্পে ছিল ভরপুর সেখানে আল্লাহু আকবার ধ্বনিত হতে থাকে।  ভারতবর্ষে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি  পাবে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের সীমা যতই বিস্তৃত হতে থাকবে, তার সওয়াব শায়খুল ইসলাম খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতীর রূহে ততই পৌঁছতে থাকবে।(সিয়ারুল আওলিয়া,পৃষ্ঠা-৪৭)

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, চিশতিয়া সিলসিলার মহান বুজুর্গ ও মনীষীগণের ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর চিরন্তন দাবি ও অধিকার রয়েছে। (গোলাম আলী আযাদ, মাআছিরুল কিরাম,পৃষ্ঠা-৭)।

হযরত খাজার জীবদ্দশায় ভারতবর্ষের রাজনৈতিক কেন্দ্র আজমীর হতে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয় এবং আজমীর তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খাজা কুতবুদ্দীন বখতিয়ারকে দিল্লিতে অধিষ্ঠিত করেন।  অন্যদিকে তারই একান্ত ভক্ত-অনুরক্ত খাদেম সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাশ দিল্লির মসনদে সমাসীন হয়ে সাম্রাজ্যের প্রসার, ভিত্তি সুদৃঢ়করণ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকেন।  আর খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরেই বাকি জীবন ইসলাম প্রচার-প্রসার, তালিম-তরবিয়াত ও তাজকিয়ার কাজে অতিবাহিত করেন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ইসলামী বিশ্বকোষ,দশম খণ্ড,পৃষ্ঠা-৭২৭)।

সুলতানুল হিন্দ গরীবে নাওয়ায (রাহ.)-এর জীবন দর্শন :

আজ ৬ই রজব ১৪৩৪ হিজরী সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমেরী (রাহ.) এর ৮০১ তম ওরস মুবারক উদযাপিত হচ্ছে। ৬৩৩ হিজরী ৬ই রজব/১৬ মার্চ ১২৩৬ খ্রী: তিনি ভারতের আজমীর শহরে ইন্তেকাল করেন। তিনি যে কতবড় উচ্চমার্গের অলি ছিলেন তার নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল তার ওফাতের ঠিক পর মুহূর্তেই। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমে দীন হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহ.) তাঁর আখ্বারুল আখিয়ার নামক সু-প্রসিদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, হযরত খাজা সাহেবের ললাটে তাঁর ইন্তেকালের পর পরই “হাবীবুল্লাহ মাতা ফী হুব্বিল্লাহ”(অর্থাত্ আল্লাহর হাবীব (প্রিয়তম) আল্লাহর প্রেমেই ইহ্ধাম ত্যাগ করেছেন) শীর্ষক বাক্যটি ফুটে ওঠে। তিনি উপমহাদেশে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়াসাল্লামের নায়েব হিসাবে। একথা সত্য যে, তার আগমনের বহু আগেই ইসলাম ও মুসলমানদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে এবং অনেক সুফী সাধক ইসলাম প্রচারে নিজেদের নিয়োজিত করেন। কিন্তু হযরত খাজা সাহেবের আগমনে ইসলাম প্রচারে এক বিপ্লব ঘটে এবং তা একটি সামাজিক বিপ্লবেও রূপান্তরিত হয়। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে বিশেষ করে খ্রীষ্টিয় একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। উঁচু বর্ণের হিন্দু সমাজ তাদের স্ব-ধর্মের নিচু বর্ণের লোকদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতে থাকেন। সাধারণ মানুষ উচ্চ বর্ণের লোকদের দ্বারা কীভাবে নিগৃহীত হচ্ছিলেন তার বিবরণ আবু রায়হান আল-বিরূনীর কিতাবুল হিন্দ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ.) সেই সময় এসব জাতিভেদ এবং স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তাওহীদের দর্শন প্রচার করেন। তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে লোক ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ.) ইরানের সিজিস্তান নামক স্থানে ৫৩৬/৫৩৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা গিয়াসুদ্দীন হাসান। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। খাজা সাহেব মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পৈতৃকসূত্রে তিনি একটি ফলের বাগান লাভ করেছিলেন। ইব্রাহিম কান্দুযী নামক একজন মজ্জুব বুযুর্গের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি তাঁর ফলের বাগান অন্যদের দান করে দুনিয়াত্যাগী একজন সাধক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করেন। আল্লাহর রাস্তায় সফরকালীন সময় নিশাপুরের নিকটে হারূন বা হারভান নামক স্থানে চিশিতয়া তরীকার প্রখ্যাত শায়খ হযরত খাজা উসমান হারূনী (অনেকের মতে হারভানী) এর সাক্ষাত্ ঘটে এবং তাঁর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। ভারত আসার পথে তিনি লাহোরে প্রখ্যাত সূফী হযরত আলী উসমান হুজভিরী (দাতা গঞ্জে বখ্শ) রাহ.-এর মাজারে চিল্লাহ (চল্লিশ দিন অবস্থান) করেন। যেখান থেকে ভারতের আজমীরে পৌঁছান। সেখানকার রাজা ছিলেন পৃথ্বীরাজ। দিল্লীও তখন তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পৃথ্বীরাজ ছিলেন মুসলিম বিদ্বেষী। নিচু বর্ণের হিন্দুরাও তাঁর দ্বারা অত্যাচারিত হতেন। আজমীরে খাজা সাহেবের আগমনের ফলে দলে দলে লোক তাঁর দরবারে আসা শুরু করেন। এতে পৃথ্বীরাজ খাজা সাহেবের প্রতি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং তাঁর মুরীদ ও ভক্তদের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। খাজা সাহেব পৃথ্বীরাজের এই ব্যবহারে অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তাঁর পবিত্র জবান থেকে নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি বেরিয়ে আসে “পিথ্রা যিন্দাহ্ গেরেফতাম, ওয়া মুসালমানান দাদেম” অর্থাত্ পৃথ্বীরাজকে জীবিত বন্দী করলাম এবং মুসলমানদের দান করলাম। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, খাজা সাহেবের এই বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছিল। আফগানিস্তানের অন্তর্গত ঘোর প্রদেশের শাসনকর্তা মঈমুদ্দীন মুহাম্মদ বিন সাম, যিনি শাহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘোরী নামে সমধিক পরিচিত। স্বপ্নযোগে হযরত খাজা সাহেবের নির্দেশ পেয়ে ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লীর সন্নিকটে উভয়ের মধ্যে চরম যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দেড়শ ভারতীয় রাজন্যবর্গ পৃথ্বীরাজের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু তাঁদের সকল প্রতিরোধ চূর্ণ করে ঘোরী বিজয়ী হন এবং পৃথ্বীরাজকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করা হয় এবং সুলতানের নির্দেশে তিনি নিহত হন। এভাবে এই মহান সাধকের দোআয় এই অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ রেহাই পান। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তীর দরবারে গরীব, ধনী সবাই সমানভাবে সমাদৃত হতেন। গরীব মিসকিনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এজন্য তাঁর অত্যন্ত বহুল প্রচলিত উপাধি হল গরীবে নাওয়ায। হযরত গরীবে নাওয়ায এর রূহানী ফায়েযে এত বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যে, ইতিহাসে আর কোন মনীষীর হাতে এত অধিক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ নেই। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নেতা খাজা হাসান নিজামী বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ পর্যালোচনা করে তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থ নিজামী বাঁসরীতে উল্লেখ করেন যে, হযরত গরীবে নাওয়ায এর হাতে প্রায় এক কোটি লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর এভাবেই সারা ভারত বর্ষে ইসলামের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। আজ এই উপমহাদেশে পঞ্চাশ কোটির অধিক মুসলমানের বাস। এর মূল ভিত হযরত গরীবে নাওয়ায স্থাপন করে গেছেন।

ইন্তেকাল :

খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ৯০ বছর বয়সে তিনি এমন মুহূর্তে ইহজগৎ ত্যাগ করেন, যখন ভারতবর্ষের মাটিতে তারই নিজ হাতে লাগানো চারা ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব শুক্রবার ইন্তিকাল করেন। প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে তার সমাধিস্থলে ওরস অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে সমবেত হয়।

তথ্যসূত্র : সংগৃহিত।

লেখক :

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রাহমাতুল্লা)-এর নগণ্য আশেক

আজম পাটোয়ারি

প্রকাশক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুকে আমরা